পাল পাড়া বনাম মিত্র পাড়া
ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। এই মূলমন্ত্রে একটি দেশ কী অপূর্ব সম্প্রীতিতে এগিয়ে চলছে, তা না দেখলে, হয়তো বিশ্বাস করা যায় না।... বাংলাদেশের লেখিকার কলমে ওপার বাংলার দুর্গাপুজো।

|
ছোট শহরগুলোতে একটা ভালোবাসার মাখামাখি থাকে। সবাই সবার চেনা, নয়তো মুখ চেনা। অমুক ভাই তমুক দাদা, পাড়ার গণবৌদি,গণ মাসিমা।... প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে সদ্য গোঁফ ওঠা দাদারা নব্য কিশোরীদের প্রেমে মাতোয়ারা। বে-পাড়ার ছেলে ঢুকলেই ঠ্যাং খোড়া করে দেবে যেন সব।... পাড়ার মাসিমার সঙ্গে খালাম্মাও ভীষণ ব্যস্ত নাড়ু বানানোয়। কোথাও কোনও বিভেদের বিষবাষ্প খুঁজে পাওয়া যায় না।... মহাষষ্ঠীর সকালে বাংলাদেশ থেকে ওপার বাংলার পুজোর নিটোল ছবি আঁকলেন সুদীপা বড়ুয়া |
আমাদের বাড়িটা ছিল পাল পাড়া আর মিত্র পাড়ার এক্কেবারে মধ্যিখানে। পাল পাড়াটা ছিল একেবারেই গা ঘেঁষে। পাঁচিলের এপার ওপার। পুজোর সময়টাতে দু'পাড়াই একটা করে মাইক আমাদের দিকে দিয়ে রাখত!! এ পাড়া যদি হেমন্ত ছাড়ত ওমনি ওপাড়ায় মান্না দে শুরু হয়ে যেতেন। এদিকে সন্ধ্যা তো ওদিকে আরতি।
বাসায় ক্যাসেট প্লেয়ার থাকলেও অত অত তো আর ক্যাসেট কেনা হতো না। যত কিংবদন্তি শিল্পী আর তাঁদের গান ওই সময়ই শোনা হয়ে গেছিল।
তখন তোমার ২১ বছর বোধহয়...
আমিও ঠিক তখন অষ্টাদশীই ছিলাম। কী রোমাঞ্চ, কী আকুলতায় বিভোর হয়ে গানটা শুনেছিলাম।
তুমি আমার মা, আমি তোমার মেয়ে...
বুকের ভেতরটায় গুড়্গুড়িয়ে উঠত শুনে। রুবি রায় আর ওগো বৃষ্টি তুমি শুনে শুনে মনে তখন প্রবল তুফান!! পুজোর ওই ক'টা দিন মাকে ঘ্যানঘ্যান করে মাথা নষ্ট করতাম। কেন আমাদের ঈদ-পুজো কিচ্ছু নেই!!!
ALSO READ। পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর অভিনব ভাবনায় 'গানে গানে দুর্গাপুজো'
তবে বিকেল হতে না হতেই সদলবলে পুজো দেখে বেড়ানো, কটকটি আর তেলে ভাজা, নাড়ুর লোভে ভারতিদির বাড়িতে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকা, ধুনোর গন্ধ, বারান্দার রেলিংয়ে হেলান দিয়ে বিভোর হয়ে গান শোনা...
ছোট শহরগুলাতে একটা ভালোবাসার মাখামাখি থাকে। সবাই সবার চেনা, নয়তো মুখ চেনা। অমুক ভাই তমুক দাদা, পাড়ার গণবৌদি,গণ মাসিমা।
পাড়ার উঠতি দাদারা আরতি নাচে কী কেরামতিই যে দেখাত!! সলমান আর জগদীশ, পরম আর রুশদী সব তখন হরিহর আত্মা। পাড়ার সম্মান রক্ষায় জুটি বেঁধে কী নাচ কী নাচ!!
ALSO READ। জয়তী-শ্রীজাত-প্রত্যুষদের নিয়ে 'গানে-আড্ডায় পুজো'
প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে সদ্য গোঁফ ওঠা দাদারা নব্য কিশোরীদের প্রেমে মাতোয়ারা। বে-পাড়ার ছেলে ঢুকলেই ঠ্যাং খোড়া করে দেবে যেন সব। রুবি রায় প্রায় সবার মনেই দোলা দিয়ে গেছেন। কিছুটা বয়স্ক, বিজ্ঞ জনেরা কফি হাউজের আড্ডার মৌজে মজে থাকেন। এরই মাঝে চার চারটে দিন ধরে শারদীয় দুর্গাপুজো সাড়ম্বরে মাতিয়ে রাখত পাড়াকে পাড়া। দলে দলে মানুষ, মানুষের ঢল। ছেলে বুড়ো, আবালবৃদ্ধবনিতা জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবাই ওই ক'টা দিন যেন মাতোয়ারা। পাড়ার মাসিমার সঙ্গে খালাম্মাও ভীষণ ব্যস্ত নাড়ু বানানোয়। কোথাও কোনও বিভেদের বিষবাষ্প খুঁজে পাওয়া যায় না। ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। এই মূলমন্ত্রে একটি দেশ কী অপূর্ব সম্প্রীতিতে এগিয়ে চলছে, তা না দেখলে হয়তো বিশ্বাস করা যায় না।
আশ্বিনের এই চারটে দিন মা যখন তার ছানা-পোনাদের নিয়ে আসেন এবং তার পরে চলে যান তখন ঢাকের বাড়িটাও কেমন যেন মন কেমন করিয়ে দেয়। মহালয়ার দিন থেকে দিন গোনা শুরু হয়ে যেত। পুজো পুজো গন্ধের সঙ্গে ধূপধুনো, শিউলি ফুল, নাড়ু আর গজা, সাদা শাড়ি লাল পাড়, প্যান্ডেল হপিং, গাদাগাদি ঠেলাঠেলি করে পুজো দেখা, তিলের কটকটি, সব কিছু নিয়ে শরৎ তার অরুণ আলোর অঞ্জলি দিয়ে পুজোর ক'টা দিন ভরিয়ে রাখে প্রকৃতিকে। ভরে থাকি আমরাও।
ALSO WATCH।